• weather ৩১.৯৯ o সে. আদ্রতা ৭০%
  • শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
img

সিনেমা হল এখন ঠাকুরগাঁওয়ে রুপকথার গল্প

প্রকাশিত : ২০২০-০৩-০১ ২১:১০:১৭
photo

গৌতম চন্দ্র বর্মন,ঠাকুরগাঁওঃঠাকুরগাঁওয়ে এখন  সিনেমা হলের সামনে গেলে বোঝার উপায় নাই যে এটা একটা সময় সিনেমা হল ছিল। একটা সময় ছিল যখন সিনেমার টিকিটের জন্য হলের সীমানা পেরিয়ে মানুষের লাইন চলে যেত রাস্তার উপর। সেই সিনেমা পড়ার কথা আজ রুপকথার গল্প হয়ে দাড়িয়েছে।

গরমের দুপুরে ধাক্কা-ধাক্কি, মারামারি, ব্ল্যাকারদের নির্বিকার মুখ হল্লা, হয়তো কখনো বৃষ্টিতে কাক ভেঁজা হয়ে হাতের মুঠোয় পাওয়া একটা অথবা দুটো টিকিট পেয়ে কি আনন্দে ফেটে পরতো মানুষ। এটা ছিল একটা সময়ের সিনেমা হলের দৃশ্য।এখন চোখে দেখা যায় না এমন দৃশ্য, আজ শুধুই এসব কথা রুপকথার গল্পতেই শোভা পায়, বাস্তবে মেলা ভার। আজ কোথায় সেই দৃশ্য, কোথায় সেই হুমরী খেয়ে পরা ভীর, আজ কোথায় সেইসব দিনের মানুষেরা, হারিয়ে গেছে।

বদলে যাওয়া সময় বদলে দিয়েছে দৃশ্যপট, বলছে দিয়েছে পেক্ষাপট। ঠাকুরগাঁওয়ে সিনেমা ভাগ হল ইতিপূর্বে বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক ঐতিহ্যবাহী হল এখন গোডাউন/মার্কেটে পরিনত হয়েছে।   হারিয়েছি আমাদের এ জেলার সিনেমা হল গুলো। কত বাহারী  নামের হল ছিল। শেষে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে  ঠাকুরগাঁওয়ের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত বলাকা সিনেমা হল। সিনেমা পাড়ার জন্য এক খারাপ সংবাদ চলছে বর্তমানে।

পেছনে ফেরা যাক,সে সময় কতো লোকযে বাপের দৃষ্টি এড়িয়ে, বড় ভাইয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে, কিংবা পরিবারের সকলের দৃষ্টির আড়াল করে পাঁচ টাকা সাত টাকা জমিয়ে দশ কিলো পায়ে হেটে গিয়ে একটি সিনেমার টিকিট কিনে সিনেমা দেখেছে তা সংখ্যায় পরিমাপ করা যাবে না।সে সময় গুলোতে ভাই যেত ভাবিকে নিয়ে, দুলাভাই যেত শালা -শালীকে নিয়ে, প্রেমিক যেত প্রেমিকাকে নিয়ে। আর ঈদ, পূজা -প্লাবন এলেতো এর সংখ্যা বেড়ে দাড়াতো কয়েক গুনে। কারন এই সময় গুলোতেই বছরের সেরা সেরা ছবিগুলো মুক্তি পেত। গ্রামে গন্ঞ্জে রিক্সা টেম্পুতে মাইক লাগিয়ে জোরালে শব্দে প্রচার করা হতো এই সব সিনেমার খবর। কানে ভেসে আসতো সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর -আসিতেছে আসিতেছে বাংলার সুপার ডুপার হিট নায়ক ...?সিনেমা ।

কতো বাহীরি সব সিনেমা হলের নাম। তখন সিনেমা শিল্প ছিল স্বর্ণ মহিমায় উজ্জ্বল। সেই রাজাজ্জ, কবরী, ববিতা, ফারুক, সাবানা, আলমগীর, রোজিনা থেকে শুরু করে মান্না, রিয়াজ, শাবনূর,মৌসুমী, পূর্নিমা,পপি, ফেরদৌস পর্যন্ত দেখা মিলতো এ দৃশ্য।আজ এ শিল্প তার হারাতে বসেছে।

আর সে সময় সিনেমাকে বই,হল কে পেক্ষাগৃহ বলা হতো আজ অনেকেই তা ভুলে গেছে। সে সময় ছিল নে এমন ছিমছাম পরিবেশ, সাজানো গোজানো সিনেমা হল, তবুও ছিল উপছে পরা দর্শক।সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মাত্রা চরম আকার ধারন করতো, হুমড়ি খেয়ে পড়তো দর্শক। আবার কেউ কেউ কাজের চাপে পরিবারকে সময় না দেওয়ার কারনে ঐ দিনটি বেছে নিত সিনেমা দেখাতে।

সে সময় দৈনিক পত্রিকায় শেষ পৃষ্টায় বড় বড় সাইজে ছাপা হতো মুক্তি অপেক্ষারত সিনেমার পোষ্টারের বিজ্ঞাপন। একটা সময় এই প্রচার মাধ্যমই ছিল সিনেমা হলের অনুষঙ্গ। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ শিহোরন কাজ করতে সিনেমা প্রেমিদের মনে।

আজ যে কটা হল আছে তাতে দেখা যায় না টিকিট ব্ল্যাকারদের। যদিও এখন দেখাও যায় তবে তার সংখ্যা নাই বললেই চলে, হাতে গোনা হয়তো দুই একজন থাকতে পারে। আর সেই সোনালী সময়ে একটা সিনেমা হল থাকতো সেই এলাকার মাস্তানদের দখলে। সিনেমার টিকেট বেচার জন্য তাদের নিয়োজিত কিছু গরীব মানুষ চড়া মূল্যে বিক্রি করতো টিকিট গুলো।মাস্তানরা সিনেমা মুক্তির আগেই বেশিরভাগ টিকিট কিনে নিত। আর সেই টিকিট চলে যেত ব্ল্যাকারদের হাতে। তারপর সিনেমা মুক্তি পেলেই দুপুরের আগেই হলের সামনে টানিয়ে দেওয়া হতো হাউস ফুল, তখন বাধ্য হয়েই ব্ল্যাকারদের থেকে টিকেট কিনতে হতো সাধারণ দর্শকদের। আবার টিকিট না পেয়ে মারামারি লেগেই থাকতো হলের সামনে। পকেটমারদের তো ছিল রমরমা ব্যবসা।

তৎকালীন সময়ে সিনেমা হলগুলোতে কাঠের ভাঙ্গা চেয়ার, নষ্ট ফ্যান, গরমে মানুষের হৈহুল্লোর চিৎকার চেচামেচির মধ্যেও বসে সিনেমা উপভোগ করতো। মাঝে মাঝে আবার বিদ্যুৎ চলে যেত সিনেমা চলার মাঝখানে। আর আজ  এতো উন্নতি হওয়ার পরেও সিনেমা হল গুলোর তেমন উন্নতি হয়নি, আর যে হলগুলোতে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে তাতেও দর্শক মেলা দুষ্কর।

অনেকেরই সে সময় সিনেমার টিকেটের টাকা জোগাড় হতো স্কুল, কলেজের টিফিনের টাকা দিয়ে, কারো আবার জোগার হতো মায়ের জমানো টাকা মেরে দিয়ে আবার কারো কারো জোগাড় হতো বাবা, দাদুর পকেট মেরে। এই সিনেমা দেখে কারো কারো টিকিট ফেলে দেওয়ার খেয়াল থাকতো না, পকেটেই রেখে দিত। এই শার্ট -প্যান্ট মায়ের কাছে ধোয়ার জন্য দিলে সেই টিকিট চলে যেত মায়ের হাতে। আর সেই টিকিট দেখে মেয়েরা কতইনা বকা-জকা করতো। স্কুল, কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা!

এসব আজ আর হয়না,ঠাকুরগাঁও জেলার  সব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। এক সময় এ জেলা উপজেলা মিলে প্রায় ৮ টি সিনেমা হল ছিল। বর্তমানে জেলার প্রাণকেন্দ্রে একটি মাত্র চলে তাও মাঝে মধ্যে এখন সেটিও আবার গোডাউন।

ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলগুলো এখন গোডাউনে পরিনত হয়েছে। এতেই পরিষ্কার এই জেলার সিনেমার অবস্থা। যে একটি সিনেমা হল রয়েছে সেটা চালাতে হিমশিম খেতে হয় মালিক পক্ষের। নেই দর্শক, তৈরি হয়না উত্তেজনা, হয়না আগের মতো লোক সমাগম। হলের চেয়ার ফাঁকা, প্রযোজক পাচ্ছে তার লগ্নির টাকা ফেরত, অনেক প্রযোজক আর আসেনা এই শিল্পে ব্যবসা করতে। দিনদিন চলচ্চিত্র শিল্প হারাচ্ছে তার ঐহিত্য আর সিনেমা হল হচ্ছে গোডাউন,মার্কেট।

© ঠাকুরগাঁও ৭১

ফোন : +৮৮০১৭১৭৮০১৪৪০
ইমেইল : info@thakurgaon71.com